ভূমিকা
মানুষের শরীর এক বিস্ময়কর যন্ত্রের মতো, যেখানে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নিজস্ব দায়িত্ব রয়েছে। পুরুষের প্রজননতন্ত্রে প্রোস্টেট গ্রন্থি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই অঙ্গটি নিয়ে আমাদের মধ্যে সচেতনতা অনেক কম। অনেক পুরুষই জানেন না যে বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রোস্টেটের নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে এবং এটি স্বাভাবিক জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
কেন প্রোস্টেট রোগ নিয়ে সচেতন হওয়া জরুরি?
এটি মূত্রনালীতে সমস্যা তৈরি করতে পারে।
যৌন জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে।
অবহেলা করলে মারাত্মক অবস্থায় ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে।
সময়মতো সঠিক চিকিৎসা পেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
প্রোস্টেট কী?
প্রোস্টেট হলো একটি ছোট আকারের গ্রন্থি, যা পুরুষের মূত্রাশয়ের নিচে এবং মূত্রনালীর চারপাশে অবস্থিত। এর আকার অনেকটা আখরোটের মতো। এই গ্রন্থির প্রধান কাজ হলো বীর্যের জন্য তরল পদার্থ তৈরি করা। সেই তরল বীর্যের সঙ্গে মিশে শুক্রাণুকে সক্রিয় রাখে এবং গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়ায়।
প্রোস্টেটের প্রধান কার্যাবলী:
1. বীর্য তৈরির জন্য তরল নিঃসরণ।
2. মূত্র ও বীর্য প্রবাহের নিয়ন্ত্রণ।
3. প্রজননক্ষমতা বজায় রাখা।
অর্থাৎ, প্রোস্টেট শুধু প্রজননের জন্যই নয়, বরং মূত্রত্যাগের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
প্রোস্টেট রোগ কী?
যখন প্রোস্টেট গ্রন্থির আকার, গঠন বা কার্যকারিতায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটে, তখন তাকে সাধারণভাবে প্রোস্টেট রোগ বলা হয়।
প্রোস্টেট রোগের ধরন বিভিন্ন হতে পারে—
কোনো সময় এটি সংক্রমণ (Prostatitis) এর কারণে হয়।
আবার বয়স বাড়লে প্রোস্টেট গ্রন্থি বড় (BPH) হয়ে যায়।
সবথেকে ভয়ংকর হলো প্রোস্টেট ক্যান্সার, যা অনেক সময় দেরিতে ধরা পড়ে।
প্রোস্টেট রোগের প্রধান ধরণ
প্রোস্টেটের সমস্যাকে মূলত তিনটি বড় শ্রেণিতে ভাগ করা হয়:
1. প্রোস্টেটাইটিস (Prostatitis) → প্রদাহ বা ইনফেকশনের কারণে ঘটে।
2. বিনাইন প্রোস্টেটিক হাইপারপ্লাসিয়া (BPH) → বয়সজনিত কারণে প্রোস্টেট বড় হয়ে যাওয়া।
3. প্রোস্টেট ক্যান্সার (Prostate Cancer) → সবচেয়ে গুরুতর রূপ, যেখানে কোষ অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে।
১. প্রোস্টেটাইটিস (Prostatitis)
প্রোস্টেটাইটিস কী?
প্রোস্টেটাইটিস হলো প্রোস্টেট গ্রন্থির প্রদাহ বা সংক্রমণ। এটি যেকোনো বয়সে হতে পারে, তবে সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ বছরের পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
প্রধান লক্ষণ:
প্রস্রাবে জ্বালা ও ব্যথা
ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ
তলপেটে, কোমরে বা পিঠে ব্যথা
বীর্যপাতের সময় ব্যথা
মাঝে মাঝে জ্বর ও দুর্বলতা
কারণ:
ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ
অনিয়মিত যৌন জীবন
দীর্ঘ সময় বসে থাকা
মানসিক চাপ
২. বিনাইন প্রোস্টেটিক হাইপারপ্লাসিয়া (BPH)
BPH কী?
বয়স বাড়লে প্রোস্টেট গ্রন্থির কোষ সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং প্রোস্টেট আকারে বড় হয়। এটিই BPH নামে পরিচিত। এটি ক্যান্সার নয়, তবে খুবই সাধারণ একটি সমস্যা।
BPH-এর প্রধান লক্ষণ:
- ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ
- রাতে বারবার প্রস্রাবের প্রয়োজন
- প্রস্রাব শুরু করতে দেরি হওয়া
- প্রস্রাবের ধারা দুর্বল হওয়া
- প্রস্রাবের পরেও অসম্পূর্ণতা অনুভব করা
- প্রস্রাব আটকে যাওয়া (Urinary retention)
- মূত্রথলির সংক্রমণ
- কিডনির ক্ষতি
প্রোস্টেট ক্যান্সার কী?
প্রোস্টেট গ্রন্থির কোষ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেলে ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ক্যান্সার তৈরি হয়। এটি ধীরে ধীরে বাড়লেও অবহেলা করলে জীবনহানির কারণ হতে পারে।
প্রধান লক্ষণ:
- প্রস্রাবের সমস্যা (ঘন ঘন চাপ, ব্যথা, রক্ত দেখা)
- কোমর ও হাড়ে ব্যথা
- যৌন অক্ষমতা
- শরীর দুর্বল হয়ে পড়া
- সার্জারি
- রেডিয়েশন থেরাপি
- হরমোন থেরাপি
- কেমোথেরাপি
প্রোস্টেট রোগ একদিনে তৈরি হয় না। বিভিন্ন ভেতরের ও বাইরের কারণে ধীরে ধীরে প্রোস্টেট গ্রন্থি প্রভাবিত হয়। রোগভেদে কারণও আলাদা হয়।
১. প্রোস্টেটাইটিসের কারণ
ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ: মূত্রনালী দিয়ে জীবাণু প্রবেশ করে প্রোস্টেট গ্রন্থিতে ছড়িয়ে পড়ে।
যৌন সংক্রমণ (STI): যেমন—ক্ল্যামাইডিয়া বা গনোরিয়া।
দীর্ঘ সময় বসে থাকা: বিশেষত ড্রাইভার, অফিসকর্মীদের ক্ষেত্রে।
অতিরিক্ত মানসিক চাপ: দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা ও প্রদাহ বাড়াতে পারে।
২. BPH-এর কারণ
হরমোন পরিবর্তন: বয়স বাড়ার সাথে সাথে টেস্টোস্টেরন ও ইস্ট্রোজেনের ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটে, ফলে প্রোস্টেট কোষ দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
বয়স: বয়সই হলো সবচেয়ে বড় কারণ।
জেনেটিক প্রভাব: পরিবারে কারও BPH থাকলে ঝুঁকি বেশি।
৩. প্রোস্টেট ক্যান্সারের কারণ
জেনেটিক মিউটেশন: কোষের DNA ত্রুটিপূর্ণ হলে অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে শুরু করে।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: অতিরিক্ত ফ্যাট, লাল মাংস খাওয়া।
অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা: শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে।
পরিবেশগত কারণ: দূষণ, কেমিক্যাল এক্সপোজার।
প্রোস্টেট রোগের সাধারণ লক্ষণ
প্রোস্টেটের সমস্যা সাধারণত ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। অনেক সময় রোগীরা বুঝতেই পারেন না যে সমস্যাটি প্রোস্টেট থেকে আসছে। নিচে প্রধান লক্ষণগুলো তুলে ধরা হলো—
১. প্রস্রাবজনিত সমস্যা
ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ → বিশেষ করে রাতে বারবার প্রস্রাবের প্রয়োজন (Nocturia)।
প্রস্রাব শুরু করতে দেরি → অনেক চেষ্টা না করলে প্রস্রাব বের হয় না।
প্রস্রাবের ধারা দুর্বল → ধীরে ধীরে বের হয় বা ফোঁটা ফোঁটা পড়ে।
প্রস্রাবের পর অসম্পূর্ণতা → মনে হয় মূত্রথলি পুরো খালি হয়নি।
জ্বালা ও ব্যথা → প্রস্রাবের সময় জ্বালা, কষ্ট বা ব্যথা অনুভূত হয়।
২. ব্যথাজনিত লক্ষণ
তলপেটে, কোমরে বা পিঠে ব্যথা
বীর্যপাতের সময় ব্যথা
কুঁচকির চারপাশে চাপ অনুভব
৩. রক্ত দেখা
প্রস্রাবে রক্ত (Hematuria)
বীর্যে রক্ত (Hematospermia)
৪. যৌন সমস্যাসমূহ
যৌন ইচ্ছা হ্রাস (Low libido)
ইরেকটাইল ডিসফাংশন (লিঙ্গ শক্ত না হওয়া)
দ্রুত বীর্যপাত বা ব্যথাসহ বীর্যপাত
৫. সার্বিক শারীরিক সমস্যা
জ্বর (বিশেষত প্রোস্টেটাইটিসে)
দুর্বলতা ও অবসাদ
ওজন কমে যাওয়া (প্রোস্টেট ক্যান্সারে বেশি দেখা যায়)
রোগভেদে বিশেষ লক্ষণ
প্রোস্টেটাইটিস
হঠাৎ জ্বর ও কাঁপুনি
প্রস্রাবে ব্যথা ও তীব্র জ্বালা
তলপেট ও পিঠে ব্যথা
BPH (প্রোস্টেট বড় হয়ে যাওয়া)
প্রস্রাব শুরু করতে দেরি
প্রস্রাবের ধারা দুর্বল হওয়া
রাতে বারবার প্রস্রাবের প্রয়োজন
প্রোস্টেট ক্যান্সার
প্রাথমিক অবস্থায় তেমন লক্ষণ নাও থাকতে পারে
পরবর্তীতে প্রস্রাবে রক্ত
হাড়ে ব্যথা (বিশেষ করে কোমরে)
শরীর দুর্বল ও ওজন কমে যাওয়া
প্রোস্টেট রোগ নিয়ে সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)
প্রশ্ন ১: প্রোস্টেট রোগের প্রাথমিক লক্ষণ কী কী?
উত্তর: ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রয়োজন, রাতে বারবার প্রস্রাব, প্রস্রাব শুরু বা বন্ধ করতে অসুবিধা, প্রস্রাবের সময় ব্যথা বা জ্বালা—এসবই সাধারণ প্রাথমিক লক্ষণ।
প্রশ্ন ২: প্রোস্টেট ক্যান্সার হলে কি সবসময় লক্ষণ দেখা দেয়?
উত্তর: সবসময় নয়। অনেক সময় প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো লক্ষণ দেখায় না। তাই ৫০ বছরের পর থেকে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি।
প্রশ্ন ৩: PSA টেস্ট কী?
উত্তর: PSA (Prostate-Specific Antigen) একটি রক্ত পরীক্ষা। এর মাধ্যমে প্রোস্টেটের অস্বাভাবিকতা বোঝা যায়। এটি ক্যান্সার শনাক্তকরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন ৪: প্রোস্টেট বড় হলে কি সবসময় সার্জারি করতে হয়?
উত্তর: না। অনেক ক্ষেত্রে ওষুধ বা জীবনধারার পরিবর্তনেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সার্জারি কেবল গুরুতর অবস্থায় প্রয়োজন হয়।
প্রশ্ন ৫: প্রোস্টেট রোগ কি বংশগত হতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, পরিবারে কারও প্রোস্টেট ক্যান্সার থাকলে ঝুঁকি বাড়ে। তাই এ ধরনের মানুষকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।
প্রশ্ন ৬: প্রোস্টেট ক্যান্সার কি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য?
উত্তর: প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। তবে দেরি হলে চিকিৎসা জটিল হয়।
প্রশ্ন ৭: যৌন জীবন কি প্রোস্টেট রোগে প্রভাব ফেলে?
উত্তর: কিছু ক্ষেত্রে সাময়িক প্রভাব পড়তে পারে, তবে সব রোগেই যৌন ক্ষমতা নষ্ট হয় না। নিয়মিত চিকিৎসা নিলে উন্নতি সম্ভব।
প্রশ্ন ৮: কোন খাবার প্রোস্টেটের জন্য উপকারী?
উত্তর: টমেটো, ব্রকলি, সবুজ শাকসবজি, বাদাম, মাছ, ফলমূল—এসব খাবার প্রোস্টেটকে সুরক্ষা দেয়। লাল মাংস ও প্রসেসড ফুড এড়ানো উচিত।
প্রশ্ন ৯: ধূমপান ও অ্যালকোহল কি প্রোস্টেটের ক্ষতি করে?
উত্তর: হ্যাঁ। ধূমপান ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় এবং অ্যালকোহল মূত্রাশয় উত্তেজিত করে।
প্রশ্ন ১০: প্রোস্টেট রোগ প্রতিরোধের উপায় কী?
উত্তর:
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
নিয়মিত ব্যায়াম
ওজন নিয়ন্ত্রণ
ধূমপান ও অ্যালকোহল ত্যাগ
এসব অভ্যাস প্রোস্টেটকে সুরক্ষিত রাখে।
উপসংহার
প্রোস্টেট একটি ছোট গ্রন্থি হলেও পুরুষের জীবনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রোস্টেট রোগের ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
প্রোস্টেট রোগ নিয়ে লজ্জা, ভয় বা ভুল ধারণা না রেখে সচেতন হতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সঠিক চিকিৎসা নেওয়া যাবে, তত দ্রুত রোগ নিয়ন্ত্রণে আসবে।
মনে রাখবেন—
সব প্রোস্টেট সমস্যা ক্যান্সার নয়।
সঠিক তথ্যই ভয় দূর করে।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা জীবন বাঁচাতে পারে।
প্রোস্টেট রোগ নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোই আজকের আলোচনার মূল উদ্দেশ্য। সুস্থ জীবনধারা, সময়মতো পরীক্ষা ও চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ—এই তিনটি মেনে চললেই প্রোস্টেট সুস্থ রাখা সম্ভব।
স্বাস্থ্যই সম্পদ, তাই নিজের যত্ন নিন, প্রোস্টেটকে সুরক্ষিত রাখুন।
0 Comments